অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের সহযোগিতা ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন বৈদেশিক বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউএসএআইডির প্রশাসক, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরিশাস, কানাডা, ইতালি, পাকিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ ও নেদারল্যান্ডসের নেতাদের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি সার্ককে পুনরুজ্জীবিতকরণে নেতৃত্ব দেওয়া, আসিয়ানে যোগ দেওয়াসহ বাংলাদেশকে অনেকগুলো আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সহযোগিতায় যুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছেন।
জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য, চীনসহ বিশ্বের বড় বড় প্রায় সব দেশ ও সংস্থা বাংলাদেশকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ আর্থিক, কেউ প্রযুক্তিগত উন্নয়নে, কেউ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, আবার কেউ বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগ আগ্রহী। এক কথায়, অধ্যাপক ইউনূসের এই কূটনৈতিক তৎপরতা বাংলাদেশের উন্নয়ন, সংস্কার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে একটা প্রায় মুখ থুবড়ে পড়া অর্থনীতিকে ইউনূস সরকার টেনে তুলছেন। এর আগে কি কখনো শুনেছেন যে কোনো দেশে একসঙ্গে দশটি ব্যাংক দেউলিয়ার পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ বাংলাদেশে তা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর দেউলিয়াত্ব, বড় বড় প্রকল্পের নাম করে অর্থ লুটপাট, বিদেশে অবৈধ অর্থ পাচার, মুমূর্ষু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতির বেহাল দশা সবই দৃশ্যমান হয়েছে। তা ছাড়া দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত, সচিবালয়, স্থানীয় প্রশাসনসহ সম্পূর্ণ প্রশাসনযন্ত্র এবং প্রধানমন্ত্রীসহ সব এমপি ও মন্ত্রী সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ফলে দেশে জুলাই বিপ্লবের মতো এত বড় একটি গণ–অভ্যুত্থানের পর দুর্ভিক্ষ হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স ও ইউনূস সরকারের নেতৃত্বে সেই অর্থনীতি এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কেউ না বুঝলেও একজন অর্থিনীতিবিদ হিসেবে আমি বুঝি এটি কত বড় সফলতা। রাজনৈতিক সংকট, শত শত আন্দোলন, প্রতিবিপ্লবের চেষ্টা এবং প্রতিবেশী দেশের প্রোপাগান্ডার কথা না হয় এই মুহূর্তে বাদই দিলাম।
অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের কাছে ক্রমেই একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সরকার হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে। এটি পতিত হাসিনা সরকার, তাঁর দল এবং দিল্লির বড় মাথাব্যথার কারণ। দিল্লির দুঃখ বোঝা খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। দেখুন, দিল্লি এখনো ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেনি। কিছুদিন আগে ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদি বলেছেন, বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে দুই দেশের মধ্যে সামগ্রিক সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। এর মানে ইউনূস সরকার থাকাকালীন দিল্লি ঢাকার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরিতে রাজি নয়।
ভারতের মিডিয়াগুলো ইউনূস সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা শুরু করেছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর দিল্লির মূল প্রোপাগান্ডা হলো বাংলাদেশে মৌলবাদীর উত্থান হচ্ছে। এই বানোয়াট ন্যারেটিভের মাধ্যমে দিল্লি দীর্ঘ সময় ধরে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখেছে এবং নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। এখনো সেই ন্যারেটিভ তারা ব্যবহার করে চলেছে। অথচ দিল্লির বর্তমান সরকার নিজেই একটি মৌলবাদী সরকার।বাংলাদেশের মানুষ চায়, অধ্যাপক ইউনূস যেমন দিল্লির প্রোপাগান্ডা ও আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের কাছে নতি স্বীকার করেননি, তেমনি কারো চাপে তাড়াহুড়া করে নির্বাচনের দিকেও হাঁটবেন না। প্রয়োজনীয় সময় নেবেন। বিচার ও প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করবেন। দেশের অর্থনীতিতে একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করে দেবেন।
দিল্লির আরেকটি ন্যারেটিভ হলো বাংলাদেশে হিন্দুরা কেবল আওয়ামী লীগ সরকারের হাতেই নিরাপদ ছিল। হাসিনা সরকার না থাকায় এখন নাকি বাংলাদেশের হিন্দুরা নিরাপদ নয়। অনেক ভারতীয় মিডিয়া প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে যে বাংলাদেশে এখন ব্যাপক নির্যাতন, এমনকি হত্যার শিকার হচ্ছে।
এই প্রোপাগান্ডার জবাবে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার ভারতীয় মিডিয়াসহ সব আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বাংলাদেশে এসে প্রকৃত অবস্থা স্বচক্ষে দেখে যাওয়ার জন্য। অনেক আন্তর্জাতিক মিডিয়া বাংলাদেশে গেছে এবং পরবর্তী সময়ে রিপোর্ট করেছে। তারা বলছে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা এখন হাসিনা সরকারের সময়ের চেয়ে ভালো আছে।
সত্যি কথা হলো, দিল্লি বাংলাদেশ থেকে আগের মতো ইচ্ছামাফিক সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছে না। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, ভারতকে তিনি এত কিছু দিয়েছেন যে ভারত সারাজীবন মনে রাখবে। হাসিনার মন্ত্রীরা এমনকি দিল্লি-ঢাকার সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই অসম সম্পর্কে বাংলাদেশ দিল্লিকে শুধু দিয়েই গেছে। বিনিময়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর দল ক্ষমতা পেয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ কিছুই পায়নি
Post a Comment